Breaking News

প্রেয়সী | পার্ট: ৯ | লেখিকা: সুলতানা তমা

নূপুরের রিনিঝিনি শব্দ আমার কানে ভেসে আসছে, কোথা থেকে আসছে এই শব্দ? আবারো আমি স্বপ্ন দেখছি নাতো? লাফ দিয়ে উঠে বিছানায় বসলাম, ঘুম ঘুম চোখে সামনে তাকাতেই দেখি অর্পি। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে হাতের বই গুলো টেবিলে রাখতে গেল। চোখ কচলে পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম, এইটা কি সত্যি আমার রুম?
অর্পি: গোয়াল ঘরটাকে একটু মানুষের ঘরে পরিণত করলাম। (অর্পির কথা শুনে লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকাতে শুরু করলাম)
অর্পি: নিজে যখন নিজের রুম গুছিয়ে রাখতে পারেননা তখন বিয়ে করে বউ নিয়ে আসলেই তো পারেন।
আমি: তুমিই তো আমার বউ। (আনমনে কি বলে ফেললাম? ভুলেই যাই এই বিয়েটার কোনো মানে নেই। অর্পি আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে)
আমি: সরি।
অর্পি: রাতে তো খুব কান্না করলেন, এবার যান ফ্রেশ হয়ে নিন নাহলে মাথা ব্যথা করবে। (রাতের কথা মনে পড়লো, কাঁদতে কাঁদতে পাগল প্রায় হয়ে যাচ্ছিলাম, অর্পি আমাকে রুমে নিয়ে এসেছিল আর বিছানায় শুয়ে দিয়েছিল। তারপর আর কিছু মনে নেই। ট্রি-শার্ট.. ট্রি-শার্ট কোথায়?)
আমি: অর্পি আমার ট্রি-শার্ট…
অর্পি: আলমারিতে রেখেছি।
আমি: হুম।
অর্পি: ভালোবাসার মানুষের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চান ভালো কথা কিন্তু তাই বলে নিজেকে এভাবে কষ্ট দিয়ে? নিজেকে যে এভাবে কষ্ট দেন আপনার কিছু হলে আপনার বাবা মায়ের কি হবে?
সাজিদ: এজন্যই তো বলি ওর একটা ভালোবাসার মানুষের প্রয়োজন। যে আয়াসকে অতীত থেকে বের করে আনবে আর নতুন করে বাঁচতে শিখাবে। (সাজিদ রুমে ঢুকতে ঢুকতে কথা গুলো বললো, ওর মাথায় এই একটাই চিন্তা। ওদের রেখে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম)
তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে রুমে ঢুকছিলাম হঠাৎ সাজিদ আর অর্পির দিকে নজর পড়লো, সাজিদ অর্পির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মৃদু হেসে তোয়ালেটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে সাজিদের কাধে হাত রাখলাম।
আমি: অর্পির বয়ফ্রেন্ড এর সাথে ওর শুভ দৃষ্টি হয়ে গেছে, শুধু সিঁদুর দেওয়া বাকি। শুভ দৃষ্টি আর করতে…
সাজিদ: সিঁদুর? এটাই তো আসল। এইটা বাকি মানে বিয়েটা আর হবেনা। আর বয়ফ্রেন্ড? কতদিন বেচারা অপেক্ষা করে থাকবে?
আমি: হবে কারণ বয়ফ্রেন্ড ওর মামাতো ভাই’ই। অপেক্ষা তো অবশ্যই করবে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছি আর অর্পিকে আয়নায় দেখছি, কতক্ষণ কি যেন ভেবে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। সাজিদ আনমনা হয়ে কি যেন ভাবছে। এয়ারপোর্টেও আমি লক্ষ করেছি ও অর্পিকে বারবার দেখছে, তবে কি সাজিদ অর্পিকে… কিন্তু এ কি করে সম্ভব? অর্পি তো হিন্দু সাজিদ চাইলেও অর্পিকে বিয়ে করতে পারবে না। তাছাড়া আমাদের ডিভোর্স এর পর দুর্জয় অর্পিকে বিয়ে করবেই। দুর্জয় এর কথা মনে পড়তেই মনে হলো অর্পিকে সত্যিটা এখনো বলা হয়নি। বুঝতেই পারছি না কি করে বলবো, দুর্জয় খারাপ কথাটা অর্পি কিভাবে নিবে? সহ্য করতে পারবে তো মেয়েটা?
ড্রয়িংরুমে এসে সোফায় বসতেই আম্মু চায়ের কাপ এনে হাতে ধরিয়ে দিলেন, আম্মু দাঁড়িয়ে আছেন দেখে বুঝলাম কিছু বলবেন।
আমি: কিছু বলবে?
আম্মু: শরীর ঠিক আছে তো? আজ এত বেলা অব্ধি ঘুমালি, ফজরের নামাজ পর্যন্ত পড়িসনি।
আমি: রাতে… (থাক রাতের কথা আম্মুকে না বলাই ভালো)
আমি: ঘুমাচ্ছি দেখেছ যখন নামাজের জন্য ডাকবে না?
আম্মু: ভাবলাম শরীর খারাপ হয়তো।
আমি: আম্মু আগে নামাজ। (আমার কথা শুনে আম্মু হাসলেন)
আম্মু: আমার ছেলেটা বড় হয়ে গেছে।
আমি: আম্মু…
সাজিদ: আয়াস চল। (সাজিদ এসে আমার হাত থেকে চায়ের কাপ কেড়ে নিয়ে টেবিলে রেখে দিলো)
আমি: কোথায়?
সাজিদ: চল তো।
আম্মু: চা’টা অন্তত খেয়ে যাক।
সাজিদ: বাইরে কিছু খেয়ে নিবো দুজনে।
সাজিদ আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসলো।
বাইক স্টার্ট দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কি আর করার পিছনে উঠে বসলাম, কিযে করে পাগলটা।
আমি: সাজিদ আমরা যাচ্ছি কোথায়?
সাজিদ: সামনেই কোনো একটা টং দোকানে।
আমি: কেন? (সাজিদ চুপচাপ বাইক চালিয়ে মোড়ের একটা টং দোকানে এসে থামলো। তারপর এক কাপ চা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমাকে ব্রেঞ্চে বসালো)
সাজিদ: ঠান্ডা মাথায় আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দেতো।
আমি: কি?
আমি: অর্পি কি সত্যিই হিন্দু? (চায়ের কাপে চুমুক দিতে যাচ্ছিলাম ওর এমন প্রশ্ন শুনে বোকার মতো ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম)
আমি: মানে?
সাজিদ: তখন কি যেন বলিছিলি অর্পির মামাতো ভাই ওর বয়ফ্রেন্ড আর ওর সাথেই অর্পি বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। তোদের ডিভোর্স এর পর ওদের আবার বিয়ে হবে তাইতো?
আমি: হ্যাঁ, ছয়মাস পর ডিভোর্স হবে আর ডিভোর্স এর পর পরই ওদের আবার বিয়ে হবে।
সাজিদ: কিন্তু হিন্দু ধর্মে তো মামাতো ভাই এর সাথে ফুফাতো বোন এর বিয়ে হয় না। (সাজিদ এর কথা শুনে ওর দিকে তাকালাম, কি বলছে ও এসব?)
সাজিদ: ধর্মের নিয়ম ভঙ্গ করে তো আর অর্পির মামা ওদের বিয়ে দিবে না, আর দিতে চাইলেও সমাজ তা হতে দিবে না।
আমি: কি বলছিস এসব?
সাজিদ: কোনো একটা ঘাপলা তো আছেই এখানে। হয় অর্পি ওদের রক্তের কেউ নয় নাহয় দুর্জয় ওদের রক্তের কেউ নয়।
আমি: কি বলিস দুর্জয় তো সুমিত দত্তের ছেলে দুর্জয় দত্ত।
সাজিদ: তাহলে অর্পি ওদের…
আমি: ওদের ব্যাপার ওরা বুঝে নিবে তুই এত ভাবছিস কেন এসব নিয়ে?
সাজিদ: অর্পি হিন্দু এটাই তো সমস্যা, অর্পি যদি মুসলিম হয়ে যেতো তাহলেই তো…
আমি: ওকে ভালোবাসতি তাই তো? (আমার কথা শুনে সাজিদ মাথা চুলকাতে লাগলো, তারমানে আমার ভাবনাই সত্যি হলো)
আমি: অর্পি কেন শুধু শুধু তোর জন্য নিজের ধর্ম ছেড়ে মুসলিম হতে যাবে?
সাজিদ: ভালোবাসায় সব সম্ভব। (সাজিদ মুচকি হেসে আবারো বাইক স্টার্ট দিলো। কিযে করতেছে ও, অর্পির প্রেমে পড়ে ওর মাথাটা একদম গেছে)
নদীর পাড়ে বসে আছি, সাজিদ পানিতে ঢিল ছুড়ছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। নিজেতো পাগলামী করছেই সাথে আমাকেও বসিয়ে রেখেছে ওর পাশে। আচ্ছা প্রেমে পড়লে কি মানুষ এভাবে পাগলামি করে? কই আমিতো করিনি, অবশ্য করবো কখন ইরাকে যে কখন ভালোবেসে ফেলেছিলাম নিজেই তো বুঝতে পারিনি। ছোটবেলার ভালোলাগা কবে যে ভালোবাসায় রূপ নিয়েছিল দুজনের কেউই বুঝতে পারিনি।
সাজিদ: ভাবছি দেশেই থেকে যাবো। (আনমনা হয়ে ইরার কথা ভাবছিলাম হঠাৎ সাজিদের কথায় ভাবনায় ছ্যাদ পড়লো। যে সাজিদকে এত বুঝিয়ে দেশে রাখতে পারিনি সে বলছে দেশে থেকে যাবে? হঠাৎ কি এমন হলো?)
সাজিদ: ছোট্ট একটা সংসার গড়বো এখানে, যে সংসারে থাকবে শুধু ভালোবাসা, খুনসুটি, দুষ্টুমি আর রাগ-অভিমান।
আমি: তোর মাথাটা একেবারে গেছে।
সাজিদ: প্রেমে পড়লে তাই হয় দোস্ত।
আমি: কিন্তু সাজিদ তুই যা ভাবছিস তা কখনো সম্ভব নয়।
সাজিদ: ভালোবাসায় অসম্ভব বলে কিছু নেই। (সাজিদকে কিছু বলতে যাবো তখনি আমার ফোন বেজে উঠলো, তনিমা হঠাৎ ফোন দিলো?)
আমি: হ্যালো।
তনিমা: ভাবি কথা বলবে।
আমি: আবারো ভাবি ডাকছিস?
তনিমা: তুই না মেনে নিস অন্যজনের তো হতে চলেছে,  আর হলে তো আমার ভাবিই হবে। (তারমানে তনিমাও জানে সাজিদ যে অর্পিকে পছন্দ করে?)
অর্পি: হ্যালো। (হঠাৎ অর্পির কন্ঠ শুনে বিব্রত হয়ে গেলাম, এই প্রথম অর্পির সাথে আমি ফোনে কথা বলছি)
অর্পি: শুনছেন?
আমি: হুম বলো।
অর্পি: বাসায় কখন আসবেন? দুপুরের খাবার বাসায় খাবেন তো?
আমি: সেটা সাজিদ জানে কারণ ও আমাকে নিয়ে কত জায়গায় যে যাচ্ছে, আসলে ওর মাথায় প্রেমের ভূত…
অর্পি: আমি সবার জন্য রান্না করছি তাই… আচ্ছা থাক আসতে হবে না। (অর্পি ফোন কেটে দিলো, মনে তো হচ্ছে অভিমান করেছে, এই মেয়েরা এত অভিমানী হয় কেন?)
আমি: ওই চল তোর অর্পি সবার জন্য দুপুরের খাবার রান্না করছে। (সাজিদ আমার কথা শুনে লাফিয়ে উঠলো)
সাজিদ: তাড়াতাড়ি চল।
বাসায় এসে ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই দেখি আব্বু, চাচ্চু আর ভাইয়া সোফায় বসা, আব্বুকে খুব টায়ার্ড লাগছে। ভাবি আর অর্পি টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে।
আম্মু: ওহ তোরা এসেছিস?
আমি: ভাইয়া, চাচ্চু আর আব্বু এই সময় বাসায়?
আম্মু: এখনি এসেছে, অর্পি ফোন করে ডেকেছে তো তাই।
আব্বু: এক গ্লাস পানি দাও তো। (এক গ্লাস পানি এনে আব্বুর দিকে এগিয়ে দিলাম, আব্বু আমাকে পানি দিতে দেখে বেশ অবাক হলেন। আব্বু পানি খাচ্ছেন আর আমি আব্বুকে দেখছি, সত্যি আব্বুর খুব কষ্ট হয়। মনে হচ্ছে এবার সবকিছু থেকে আব্বুকে অবসর দেওয়া প্রয়োজন। অনেক তো পাগলামি করলাম এবার নাহয় আব্বু আম্মুর দেখাশোনার দায়িত্ব নিবো)
ভাইয়া: আয়াস কি দেখছিস এভাবে? চাচ্চুকে টায়ার্ড লাগছে খুব? এবার অন্তত বুঝ।
আমি: তোমাকেও তো খুব টায়ার্ড লাগছে।
ভাইয়া: আব্বু আর চাচ্চুর বয়স হয়েছে, একা হাতে সব করি। এত ব্যস্ত জীবন কাটানো যায়? আমারো তো একটু…
আমি: আমি কাল থেকে অফিসে যাবো। (আমার মুখে এমন কথা শুনে সবাই হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আব্বু আমাকে পাশে বসালেন)
আব্বু: এতদিনে বুঝেছিস?
চাচ্চু: যাক অবশেষে আয়াস সব ভুলতে পেরেছে।
আমি: কিছুই ভুলিনি, তোমাদের দুজনের অবসরের জন্য আমি বিজনেস জয়েন করবো এছাড়া কিছুই না।
ভাইয়া: এতটুকুই যথেষ্ট।
ভাবি: খাবার রেডি সবাই এসো। (সবাই টেবিলের দিকে যাচ্ছে, আমি উঠতে যাবো তখনি আম্মু এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন…)
আম্মু: অর্পিতা তোর জীবনে আসার পর থেকে তুই বদলে যেতে শুরু করেছিস, আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া এই মেয়েটা যেন তোর জীবনে থেকে যায় যেকোনো উপায়ে।
আমি: আম্মু ভুল করছ, অর্পি আসায় আমি একটুও পাল্টাইনি আমি আগের আয়াস’ই আছি।
আম্মু: ইরাকে কবে কখন ভালোবেসে ফেলেছিলি সেটা যেমন বুঝতে পারিসনি এখনো ঠিক তাই হচ্ছে। অর্পিতাকে নিজের অজান্তে কখন ভালোবেসে ফেলেছিস নিজেও জানিস না। ভালোবাসিস কিন্তু সেটা উপলব্ধি করতে পারছিস না।
আমি: ভুল.. তোমরা ভুল করছ আমি অর্পিকে ভালোবাসি না। আরে অর্পিকে তো সাজিদ…
চাঁচি: খাবো না এসব। (হঠাৎ কিছু পরে যাওয়ার শব্দ শুনে টেবিলের দিকে তাকালাম। চাঁচি উনার খাবারের প্লেট ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন)
আম্মু: কি হয়েছে?
চাঁচি: বাসায় কি কাজের লোকের অভাব পড়েছে? শেষ পর্যন্ত একটা হিন্দু মেয়ের রান্না করা খাবার খেতে হবে?
চাচ্চু: এসব কি বলছ? খাবার তো খাবারই সেটা যেই রান্না করুক…
চাঁচি: তাই বলে একটা হিন্দু মেয়ের হাতের রান্না করা খাবার খাবো? (অর্পির দিকে তাকালাম, ওর দুচোখ দিয়ে পানি পড়ছে)
আব্বু: অর্পিতা খুশি মনে সবার জন্য রান্নাটা করেছিল, ওর রান্না সবাই খাবে ভেবেই তো আমাদের অফিস থেকে ফোন করে এনেছে। মেয়েটার খুশির মধ্যে তুমি ওকে কাঁদিয়ে দিলে?
ভাইয়া: আম্মু তুমি পারোও বটে।
দাদি: বড় বৌমা তোমার সাহস কিন্তু দিন দিন বেড়েই চলেছে।
ভাবি: অর্পি শুনো… (অর্পি চলে যাচ্ছিল ভাবির ডাকে পিছন ফিরে তাকালো)
অর্পি: আপনি আমার মায়ের মতো তাই বেশি কিছু বললাম না, শুধু এইটুকুই বলি হিন্দুরাও মানুষ। আর আপনার ধর্মের কোথাও লেখা নেই যে অন্য ধর্মের মানুষদের ঘৃণা করতে হবে। (চাঁচি উঠে চলে যাচ্ছেন, চাঁচিকে দেখে মনে হচ্ছেনা উনি অর্পি হিন্দু বলে ওকে ঘৃণা করছেন বরং মনে হচ্ছে উনি অর্পির উপর কোনো একটা রাগ থেকে এমন করছেন)
তনিমা: ভাবি শুনো। (অর্পি কাঁদতে কাঁদতে রুমের দিকে চলে গেল)
সাজিদ: অর্পি না খেলে এই খাবার গুলো আমিও খেতে পারবো না। (সাজিদ এসে আস্তে আস্তে কথাটা বললো, কি করবো এখন?)
সাজিদ: আমি অর্পিকে খাওয়াতে গেলে সবাই সন্দেহ করবে, তুই যা অর্পিকে খাইয়ে দিয়ে আয়। প্লিজ আমার জন্য। (সাজিদ আমার দিকে খাবারের প্লেট এগিয়ে দিলো। প্লেট হাতে নিলাম)
আমি: আব্বু অর্পি খাবে আমি খাবার নিয়ে যাচ্ছি, তোমরা খাও।
সবাই যেন আমার মুখ থেকে এই কথাটাই শুনতে চাচ্ছিল, সবাই খুশি মনে খেতে শুরু করলো।
অর্পি বিছানায় শুয়ে কাঁদছে, খাবারের প্লেট টেবিলে রেখে অর্পির পাশে বসলাম, অর্পির মাথায় হাত রাখতেই ও তাড়াতাড়ি উঠে বসে চোখের পানি মুছে নিলো।
আমি: কষ্ট হচ্ছে?
অর্পি: (নিশ্চুপ)
আমি: সবসময় লোকের কথায় কান দিলে চলে? (আমার কথা শুনে অর্পি আমার দিকে তাকালো)
আমি: লোকে কি বলবে এইটা ভাবলে তোমাকে থেমে যেতে হবে, এগুতে পারবে না সামনে। আমাদের সমাজের কাজই হলো অন্যকে নিয়ে কথা বলা, তাই বলে এত কষ্ট পেতে হবে? তুমিই বলো তুমি যদি চাঁচির কথায় কষ্ট না পেয়ে ওখানেই বসে সবার সাথে খাবার খেতে তাহলে চাঁচি লজ্জা পেতো না? অবশ্যই লজ্জা পেতো। লোকের কথায় ভেঙ্গে পড়লে চলে না অর্পি। চাঁচি তোমার হাতের খাবার খেতে চায় না যখন তখন না খাখ তাতে তোমার কি?
অর্পি: (নিশ্চুপ)
আমি: একজনের কথায় রাগ করে চলে আসলে বাকিরা কি দোষ করলো? সবাই তো ভালোবেসে ছেঁটে পুটে তোমার রান্না করা খাবার খাচ্ছে।
অর্পি: সত্যি?
আমি: হ্যাঁ এবার তুমি খেয়ে নাও।
অর্পি: ইচ্ছে করছে না।
আমি: আমি খাইয়ে দিলে খাবে? (অর্পি চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালো)
আমি: বিয়েটার কোনো মানে নেই তাতে কি? দুজনের মধ্যে তো বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠতেই পারে তাই না? (অর্পি মৃদু হেসে চুপচাপ বসে রইলো। আমি এক লোকমা ভাত ওর দিকে এগিয়ে দিলাম, ও চুপচাপ খেয়ে নিলো)
আমি: তোমার সম্পর্কে তো আমি কিছুই জানিনা।
অর্পি: কি জানতে চান?
আমি: এই ধরো তুমি কতটুকু পড়াশুনো করেছ, তুমি মামার বাড়ি থাকো কেন, তোমার বাবার বাড়ি কোথায়, তোমার বাবা কোথায় আ…
অর্পি: বাবা মারা গেছেন আমি ছোট থাকতে।
আমি: সরি তোমার মন খারাপ করিয়ে দিলাম।
অর্পি: হুম। বাবা না থাকলে কি বাবার বাড়ির মানুষ আমার দায়িত্ব নিবে? মা মামার কাছে চলে এসেছিলেন, সেই থেকে এখানেই আছি। আর পড়াশুনো? এসএসসি পাস করার পর আর পড়া হয়নি। টানাটানির সংসারে মামা দুর্জয়কে পড়াবে নাকি আমাকে? দুর্জয় পড়াশুনো শেষ করেছে এতেই আমি খুশি। (এই নামটা শুনলেই কেন যেন খুব রাগ হয়। আর কিছু বললাম না, চুপচাপ অর্পিকে খাইয়ে দিচ্ছি। হঠাৎ অর্পির দিকে নজর পড়লো, আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদছে ও)
আমি: আরে কাঁদছ কেন? কি হয়েছে?
অর্পি: মা ছাড়া আর কেউ কখনো এতো যত্ন করে খাইয়ে দেয়নি তো তা…
আমি: কেন দুর্জয় দেয়নি?
অর্পি: ধ্যাত তুমি না।
আমি: বাহ্ তোমার মুখে তুমি ডাকটা শুনতে বেশ মিষ্টি লাগে। (অর্পি জিহ্বায় কামড় দিলো)
অর্পি: সরি, ভুলে বলে ফেলেছি।
আমি: এই ভুলটা সবসময় করলেই খুশি হবো। (অর্পি মৃদু হাসলো)
আমি: আচ্ছা একটা প্রশ্ন করতে পারি?
অর্পি: হুম।
আমি: তোমাদের হিন্দু ধর্মে তো মামাতো ভাইয়ের সাথে ফুফাতো বোনের বিয়ে হয় না তাহলে তোমার আর দুর্জয় এ… (হঠাৎ কারো কান্নার শব্দ শুনে দরজার দিকে তাকালাম, মনে হলো তনিমা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে ছাদের দিকে যাচ্ছে। কি হলো হঠাৎ ওর?)
আমি: তুমি খেয়ে নাও আসছি আমি।
দৌড়ে ছাদে আসলাম, তনিমা কাঁদছে আর ফোনে কথা বলছে। কিন্তু ও ফোনে কথা বলতে বলতে ছাদের কার্নিশে যাচ্ছে কেন? সুইসাইড করতে চাচ্ছে নাতো? দৌড়ে তনিমার কাছে আসলাম, ও ছাদ থেকে লাফ দিতে যাচ্ছিল তখনি ওকে ধরে ফেললাম। ঠাস ঠাস করে দুগালে কয়েকটা থাপ্পড় দিলাম।
আমি: কি করতে যাচ্ছিলি?
তনিমা: (নিশ্চুপ)
আমি: হঠাৎ মরার সখ জেগেছে কেন? মৃত্যু এতোই সহজ?
তনিমা: হ্যাঁ সহজ, যার জীবনে ভালোবাসা নেই তার জন্য মৃত্যুই ভালো।
আমি: মানে?
তনিমা: ভাইয়া আমি একজন কে ভালোবাসি, দু বছরের সম্পর্ক আমাদের। কিন্তু ও হঠাৎ করে ব্রেকাপ করে ফেলছে, ও নাকি অন্য কাউকে ভালোবাসে।
আমি: তোর কত বছর বয়স?
তনিমা: মানে?
আমি: বল।
তনিমা: উনিশ।
আমি: দু বছরের ভালোবাসার জন্য তুই উনিশ বছরের ভালোবাসা ভুলে গেলি? চাচ্চু চাঁচি যে তোকে উনিশ বছর ধরে আগলে রেখে ভালোবাসা যত্ন দিয়ে বড় করেছে এইটা কিছুই না? আমরা যে তোকে এত ভালোবাসি এসবের কোনো মূল্য নেই?
তনিমা: (নিশ্চুপ)
আমি: কোথাকার একটা দুদিনের ছেলের জন্য তুই মরতে যাচ্ছিলি। আত্মহত্যা মহাপাপ এইটা ভুলে গেছিস? একবার মৃত্যু হলে আর কি ফিরে আসতে পারবি?
তনিমা: (নিশ্চুপ)
আমি: চাইলেও তখন আর ফিরে আসতে পারবি না বরং আত্মহত্যার মতো পাপ করার জন্য জাহান্নামে জ্বলবি। আর তুই মরে গেলে কি ছেলেটাও মরে যাবে? নাতো, ছেলেটা দিব্যি অন্য কাউকে নিয়ে সুখে থাকবে। (এই কথাটা শুনে তনিমা হুহু করে কেঁদে উঠলো)
আমি: তনিমা জীবন কারো জন্য থেমে থাকেনা। কষ্ট হবে যন্ত্রণা হবে কিন্তু একদিন সব ঠিকও হয়ে যাবে। তোর তো আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করা উচিত কারণ ছেলেটার আসল রূপ এখনি প্রকাশ পেয়েছে। যে ছেলে এখন তোকে রেখে অন্য কারো পিছনে ছুটছে সে যে বিয়ের পর অন্য নারীর পিছনে ছুটত না তার কি গ্যারান্টি? বিয়ের পর এমন হলে কি করতি? এখনি জেনে গেছিস এইটা ভালো না? তনিমা আল্লাহ্‌ যা করেন ভালোর জন্য করেন। ছেলেটা তোর যোগ্য না, যে তোর যোগ্য যে তোর জন্য পারফেক্ট আল্লাহ্‌ তাকেই তোর জন্য বেছে রেখেছেন।
তনিমা: (নিশ্চুপ)
আমি: আর সুইসাইড করার চিন্তা করবি?
তনিমা: না। কিন্তু চোখের সামনে ওকে অন্য কারো সাথে দেখলে কষ্ট হয় তো।
আমি: এগুলো আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, ইগনোর করতে শিখ বুঝেছিস?
তনিমা: তুই পারবি?
আমি: মানে?
তনিমা: অর্পি ভাবিকে অন্য কারো সাথে দেখলে তুই সহ্য করতে পারবি?
আমি: কেন পারবো না? আমি কি ওকে ভালোবাসি নাকি?
তনিমা: হ্যাঁ বাসিস তো। তুই সেটা উপলব্ধি করতে পারছিস না, যখন ভাবি অন্য কারো হয়ে যাবে তখন ঠিকি বুঝতে পারবি কিন্তু আফসোস তখন কিছুই করার থাকবে না। নিজের মনের কথা শুন ভাইয়া, নিজেকে সময় দে।
আমি: আবার শুরু করেছিস?
তনিমা: ভালোবাসা পাওয়া খুব কঠিন ভাইয়া, হারাতে দিস না। একবার হারালে আর ফিরে পাবি না ঠিক ইরা আপুর মতো।
তনিমা চলে গেল। আমি হাটু গেড়ে বসে পড়লাম। কি বলে গেল ও এসব? একবার হারিয়ে গেলে আর ফিরে পাবো না? ইরার মতো? হঠাৎ হাসির শব্দ শুনে পিছনে তাকালাম, অর্পি আর সাজিদ হাসতে হাসতে ছাদে এসেছে। অর্পির এই হাসিটা কেন যেন ভালো লাগছে না। অন্য কেউ ওকে হাসালে আমার ভালো লাগে না কেন? অর্পি কাঁদলে আমার কষ্ট হয় কেন? অর্পি না খেয়ে থাকলে আমার কি? কেন ওকে নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে আসলাম ঠিক যেমন ইরাকে দিতাম? তবে কি ইরার জায়গাটা অর্পি দখল করে নিয়েছে? অর্পি আমার আশেপাশে থাকলে সবকিছু এতো সুন্দর লাগে কেন আমার? সব প্রশ্নের উত্তর কি তবে তনিমার বলা কথাতেই আছে? আমি কি সত্যিই অর্পিকে ভালোবাসি? অর্পির দিকে তাকালাম, সাজিদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রাণ খুলে হাসছে, যে হাসি দেখে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাহলে আমি সত্যিই অর্পিকে ভালোবাসি? হ্যাঁ ভালোবাসি, নিজের অজান্তেই ওকে বুকের বা পাশটায় জায়গা দিয়ে ফেলেছি। কিন্তু ও যে হিন্দু? ও যে অন্য কারো ভালোবাসা…
চলবে?

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com