Breaking News

মন নিয়ে কাছাকাছি | পর্ব - ২৭



আবির মীরার দিকে ধাওয়া করলে মীরা ছুটে জায়িনের পেছনে গিয়ে লুকালো।

জায়িনের লম্বা চওড়া বিশাল দেহের পেছনে মীরার ছোট দেহ আড়াল হয়ে গেছে। মীরা জায়িনের পেছনে থেকেই বাঁচার জন্য বলছে,
"আবির ভাই তুমি যা বলবে আমি সব করে দিব। মাথা টিপে দেব। পানি এনে দিব। তুমি বললে তোমার পা-ও টিপে দেব। তুমি শুধু আমাকে বাদে ওদের হলুদ লাগাও।"
"উঁহু। এখন বাঁচতে এই কথা বলছিস! কিন্তু তুই-ই সবচেয়ে বেশি আমার কথার অবাধ্য হোস। তাই আগে তোকে মাখাব। জায়িন তুই সরে দাঁড়া।"
জায়িন ভাই সামনে থাকলে আবির ভাই তাকে ধরতে পারবে না বুঝতে পেরে মীরা পেছন থেকে জায়িনের পাঞ্জাবি খামচে ধরল। জায়িন ভাই সামনে থেকে সরে গেলেই আবির ভাইয়ার হাত থেকে তার রক্ষে নেই। আবির জায়িনকে বলছে,
"জায়িন তুই ওটাকে তোর পেছন থেকে বেরিয়ে আসতে বল। আজ কেউ রক্ষা পাবে না।"
মীরা জায়িনের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে তো দূর উল্টো শক্ত করে জায়িনের পাঞ্জাবি আঁকড়ে ধরল। বলল,

"না জায়িন ভাই প্লিজ। আপনি আবির ভাইয়ার কথা শুনবেন না।"
"না শুনলে। জায়িন নিজেও ভিক্টিম হবে। আমার কিছু করার নেই।"
"জায়িন ভাই আপনি আবির ভাইকে একটা শিক্ষা দিন না। আমরা ছোট মানুষ বলে আমাদের সাথে কেমন করছে দেখুন।"
জায়িন একবার ঘাড় ঘুরিয়ে মীরাকে দেখলো। মীরা ঠোঁট উলটিয়ে অসহায় মুখে অনুরোধ করলো। জায়িন আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
"আবির ছেলেমানুষী করিস না তো। বাচ্চাদের সাথে বাহাদুরি করে মজা নেই। সমানে সমানে টক্কর দিতে হয়।"
"তাহলে তুই আয় শালা।"
বলেই আবির জায়িনের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। ঘটনা আকষ্মিক ভাবে ঘটলেও জায়িন আবিরের দুই হাত হাওয়ায় ধরে ফেলল। মীরা উঁকিঝুঁকি পেরে জায়িনের পেছন থেকে আবিরকে দেখছে। আবির ভাই জায়িন ভাইকে নাগালই পাচ্ছে না। মীরা মনে মনে হাসল।
"খুব তো আমাদের সাথে বেডা গিরি দেখাচ্ছিলে। এবার জায়িন ভাইয়ের সাথে পারছো না কেন?"

এই যাত্রায় জায়িন ভাইয়ের জন্য মীরা বেঁচে গেল। নইলে আবির ভাই সত্যি সত্যিই হলুদে ডুবাতো।
বিকেল গড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। সন্ধ্যা নেমে চারদিক অন্ধকার হওয়ার আয়োজন চলছে। এবার মীরাদের ফেরার পালা। ইভান ভাইকেও তো এখনও হলুদ দেওয়া হয়নি। মীরা মুখ ধুয়ে টিস্যু খুঁজছিল। একটা তোয়ালে টোয়ালে পেলেও হতো। আবির ভাইরা বেরিয়ে পড়েছে। মীরা মুখ ধোয়ার জন্য ভেতরে এসেছিল। টিস্যু, তোয়ালে পায়নি কিন্তু মুবিন ভাইকে পেয়ে গেল। মীরা মুবিনকে দেখেই বলল,
"মুবিন ভাই টিস্যু বক্স কোথায় জানেন?"
মুবিন মীরাকেই খুঁজছিল। বুকে যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে রেখেছে। কিন্তু মীরাকেই একা পাচ্ছিল না।
মুবিন ফুসফুস ভরে দম টানলো।
"মীরা! তোমাকে কিছু বলতে চাই।"
মীরার আত্মা ধক করে উঠল। কলিজায় চিলিক দিল। শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। মাহিটা ঠিকই বলেছিল। মুবিন ভাই আজ তাকে প্রপোজ করবে! মীরা মনে মনে বলছে,
"না। মুবিন ভাই না। প্রপোজ করবেন না। রিজেক্ট হলে আপনিই কষ্ট পাবেন। বোনের বিয়েতে প্রেমে ছ্যাকা খাওয়া প্রেমিক হয়ে ঘুরে বেড়াবেন। তার থেকে ভালো প্রপোজই কইরেন না।"
"মীরা! কী ভাবছো?"

মীরার ভাবনার সুতো কাটলো। হুঁশে ফিরে এসে বলল,
"আমার তো সময় নেই মুবিন ভাই। আমাকে রেখে আবির ভাইরা চলে যাবে। আমাকে যেতে হবে। সামনে থেকে সরুন তো। ওইযে গাড়ির শব্দ হচ্ছে। ওরা আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছে নাকি? হায় আল্লাহ!"
মীরা কোনরকমে মুবিনকে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিচ্ছিল। মুবিন ভাইয়ের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মীরা দু'কদম বাড়িয়েছে তখনই মুবিন পেছন থেকে বলে উঠল,
"আমি মাহিমাকে পছন্দ করি মীরা।"
মীরার পা থেমে গেল। ভ্রু কুঁচকে ঝট করে মুবিনের দিকে ফিরল। সে যা শুনেছে মুবিন ভাই কি তা-ই বলেছে? মুবিন মীরার চোখের দৃষ্টি বুঝতে পেরে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
"হ্যাঁ মীরা। আমি মাহিমাকে পছন্দ করি।"
মীরা কতক্ষণ থম মেরে থেকে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল,
"মুবিন ভাই।"
মুবিন ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মীরা হঠাৎ এমন চেঁচাবে আশা করেনি। মীরা থপথপ পা ফেলে মুবিনের সামনে এসে দাঁড়াল।
"আপনি আমার সাথে মজা করছেন?"
"না মীরা। মজা করবো কেন? আমি সত্যি বলছি।"
"এই কথা তাহলে আমাকে বলছেন কেন?"
"মীরা তুমি কি রেগে যাচ্ছ? রাগ কোরো না প্লিজ।"
মীরা মনে মনে বলল,

"রাগ করব না। আমি খুশিতে মাটিতে শুয়ে সাপের মতো মোচড়ামুচড়ি করে নাগিন ডান্স করব। এতদিন হাবভাবে আমাকে পছন্দ করেন বুঝিয়ে এসেছেন। এখন এন্ড মোমেন্টে আমার বোনকে প্রপোজ করছেন? আপনাকে ফিরিয়ে দিলে কষ্ট পাবেন ভেবে আমি নিজেকে অপরাধী ভাবছিলাম। কিন্তু এখন ছ্যাঁকাটা তো আপনি আমাকেই দিয়েছেন।"
"তোমাকে বলছি কারণ, মাহিমা মনে হয় আমার ব্যাপারে এমনটা ভাবে না। কিন্তু আমি অনেকদিন ধরেই মাহিমাকে পছন্দ করি। ওকে কীভাবে বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তুমি তো মাহিমার বেস্ট ফ্রেন্ড আবার বোনও। তুমি আমার হয়ে ওকে..
"এজন্যই আমরা কলেজ যাওয়ার সময় আপনি দোকানে বসে থাকতেন?"
"তোমরা লক্ষ করেছিলে? মাহিমা লক্ষ করেছে?"
"মুবিন ভাই!"
মীরা রাগে দুঃখে শুধু শুধু চেঁচাচ্ছে। মুবিন ভাই তাকে প্রপোজ করলে সে নিজেই না করে দিত। কিন্তু এখন মুবিন ভাই মাহিমাকে পছন্দ করে। মীরার কেমন ছ্যাঁকা খাওয়া ফিলিংস হচ্ছে।
"কী মীরা?"
"আপনি মাহিমাকে দেখার জন্য দোকানে বসে থাকতেন?"
কথাটা শুনে মুবিন লজ্জা পেল। লজ্জিত ভঙ্গিতেই বলল,
"ইয়ে মানে..

" এখন আর ইয়ে মানে করছেন কেন? যা করার তা তো আগেই করে ফেলেছেন।"
"মাহিমা কি আমাকে পছন্দ করে মীরা?"
"দুধ কলা দিয়ে ঘরে এত হ্যান্ডসাম একটা ভাই পালছেন। তাকে রেখে কোন মেয়ে কেন আপনার দিকে ফিরবে? ভাইটাকে একটু কম হ্যান্ডসাম হতে বলতে পারলেন না। আপনি যাকে বাবুর আম্মু বানানোর স্বপ্ন দেখছেন সে আপনাকে চাচা বানানোর চেষ্টায় আছে।"
মনের কথা মনেই রয়ে গেল। এসব কথা মীরা মুবিনের সামনে বলতে পারল না। কইতরি শালি দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা তার কানে মন্ত্র পড়ত, মুবিন ভাই তোকে পছন্দ করে। কানা কইতরি চোখ খুললে দেখতে পেত মুবিন ভাই কাকে পছন্দ করে। কানার বাচ্চা আন্ধা, মুবিন ভাই তোকে পছন্দ করে।
"আপনি এখন কী চান মুবিন ভাই?"
"তোমার সাহায্য ছাড়া আর কী চাইব মীরা? প্লিজ তুমি আমাকে হেল্প করো।"
"কেন?"
মুবিনের কপালে ভাঁজ পড়ল।
" কেন মানে কি?"
"আপনাকে আমি কোন স্বার্থে সাহায্য করব?"
"স্বার্থ?"

"অবশ্যই। মীরা কাউকে মাগনা সার্ভিস দেয় না। মীরার সার্ভিসের দাম আছে।"
"তুমিই বলো কী চাও তুমি?"
"আমি যেদিন বলব ছুটি দিতে হবে। পড়ার চাপ তো একেবারেই দেওয়া যাবে না। কোন হোমওয়ার্ক করব না। আমার যতক্ষণ চন চাইবে পড়ব, তারপর গল্প করব। পরীক্ষায় কম মার্কস পেলেও আপনি বকবেন না। বাবা, চাচা, ভাইয়ারা জানতে চাইলে বলবেন, মীরার মতো ব্রিলিয়ান্ট, ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে এই ওয়ার্ল্ডে দু'টা নেই।"
মুবিন হাঁ করে মীরার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে এসব শর্ত রাখছে? একটু বেশি বেশি হয়ে গেল না! হলেও এখন চুপচাপ মেনে নিতেই হবে।
"আরও কিছু শর্ত আছে। সেগুলো এখন মনে পড়ছে না।"
"ঠিক আছে। মনে পড়লে বলে দিও।"
মুবিন ভাই তার সব কথা মেনে নিয়েছে দেখে মীরা বিশ্ব জয় করা হাসি দিল।
"আর হ্যাঁ, এখন থেকে তো আপনাকে মুবিন ভাই ডাকব না।"
"তাহলে?"

"দুলাভাই ডাকব। আমার বোনের সাথে প্রেম করলে সম্পর্কে আমি আপনার শালি হবো না।"
"এই না, না। তোমাকে কেউ দুলাভাই ডাকতে শুনে ফেললে প্রবলেম হয়ে যাবে মীরা।"
"এরকম পিঁপড়ার কলিজা নিয়ে তো প্রেম করতে পারবেন না দুলাভাই। মাহির ভাই জানতে পারলে ছেঁচা দিয়ে আপনার এটুকু সাহসও নিগড়ে দিবে। আমি তো শুনেছিলাম প্রেমে পড়লে ছেলেদের ছাতি ছত্রিশ হয়ে যায়। শোনায় ভুলও থাকতে পারে। তাই তো দেখছি, আপনারটা কমেছে।"
....
মীরা গাড়িতে এসে বসলে মাহিমা জিজ্ঞেস করল,
"এতক্ষণ কোথায় ছিলি?"
"তোর বন্দোবস্ত করে এলাম।"
"মানে?"
"মানে তোর মাথা। তুই আর কোনদিন ছেলেদের দেখে বলবি না এই ছেলে ওই মেয়েকে পছন্দ করে। ওই ছেলে ওই মেয়েকে পছন্দ করে। তোর ধারণা আকাশ পাতাল ভুল বেরোয়।"
"জীবনেও না। আমি ছেলেদের চোখ দেখেই বলে দিতে পারি মনে কী চলছে।"
"এই কথাটা দ্বিতীয় বার তোর মুখে শুনলে লা'থি মেরে চাপা ত্যাড়া করে ফেলব।"
মাহিমা কিছুই বুঝতে পারল না মীরা হঠাৎ তার উপর এত ভড়কে গেল কেন? সে কী করেছে? আজব!
...
বিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে হবে। বাড়ির মেয়েরা সবাই পার্লারে চলে গেছে। আবির ইভানকে পার্লারে যাওয়ার কথা বললে ইভান বলল,
"সাবান দিয়ে ঘষে মুখ ধুয়ে ফেললেই আমি সুন্দর করে যাব।"
এই কথা শুনে আবির হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। মীরাদের পার্লার থেকে নিয়ে যেতে হবে। ইভাকেও পার্লার থেকে তুলে নিতে হবে। জায়িন মুবিনকে যেতে বললে মুবিন জানাল, তার শেরওয়ানি চেঞ্জ করতে যেতে হবে। সে মল থেকে সোজা কমিউনিটি সেন্টারে চলে যাবে।

জায়িন গাড়িতে হেলান দিয়ে পার্লারের সামনে দাঁড়িয়ে ইভাকে কল করছে। ইভা আপুই তাকে কল করে আসতে বলেছিল। একঘন্টা আগে বলেছে সাজা শেষ। কিন্তু এখনও বের হচ্ছে না। জায়িনের মেডিকেলের একটা বন্ধুর কল এলে জায়িন ফোন কানে কথা বলছিল। হঠাৎ তার চোখ সামনে পড়তে জায়িন ফ্রিজড হয়ে গেল। ফোন হাত থেকে পড়েই যাচ্ছিল। জায়িন নিজেকে সামলে নিয়ে ফোন পকেটে রাখল।

সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুকে হাত বাড়ল। ইভা সহ মীরা মাহিমা সবাই বেরিয়ে আসছে। মীরার পরনে লাল টুকটুকে লেহেঙ্গা। স্ট্রেইট করা চুলগুলো খোলা রেখেছে। ডান কাঁধে ওড়না ফেলে বাঁ দিকে কিছুটা চুল সামনে এনে রাখা। দু'হাতে লেহেঙ্গা উঁচু করে ধরে হেঁটে আসছে। মাঝে মাঝে বাঁ হাতে কানের পেছনে চুল গুঁজে দিচ্ছে। জায়িনের হাঁসফাঁস লাগছে। বাতাসে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিয়েছে মনে হচ্ছে। ওরা যতটা কাছাকাছি আসছে জায়িনের নিজেকে সহজ শান্ত স্বাভাবিক রাখতে তত বেশি কষ্ট হচ্ছে।

চলবে...

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com