Breaking News

মন নিয়ে কাছাকাছি | পর্ব - ২৫

কন্ঠস্বরটা শুনে মীরা কোমর ধরে বসে থাকা অবস্থায় মাথা তুলে উপরে তাকিয়ে দেখলো। জায়িন ওর দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগে কী কী বলেছে মনে করে মীরা ঢোঁক গিললো। জায়িন মাহিমার দিকেও তাকিয়ে বলল,

"তোমারও কি কোমর ভেঙেছে? হাসপাতালে নিতে হবে?"
জায়িনের কথা শেষ হবার আগেই মাহিমা ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।
জায়িনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টেনে হেসে বলল,
"আমার তো কিছুই হয়নি জায়িন ভাই। দেখুন আমি একদম ঠিক আছি। কোন ব্যথাই পাইনি।"
মাহিমা ঘুরে ফিরে জায়িনকে দেখাচ্ছে সে যে ঠিক আছে। জায়িন দৃষ্টি মীরার উপর আবদ্ধ করলো।
মীরা এখনও বসে আছে। মাহিটা কত তাড়াতাড়ি দল পাল্টে ফেলল সেটাই দেখছে।
জায়িন ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে কী সুন্দর বলছে, কোন ব্যথাই পায়নি।
কিন্তু মীরা যথেষ্ট ব্যথা পেয়েছে। জায়িন বাড়িয়ে দেওয়া হাত ফিরিয়ে নিয়ে মীরার
দিকে ঝুঁকে আসার আগে মীরা নিজে নিজে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সে মনে করেছে জায়িন ভাই হয়তো তাকে কোলে তুলে নিবে।
সেই ভয়েই কোমর ধরে কোনরকমে দাঁড়িয়ে বলল,

"ডাক্তার হয়েছেন বলে কি মানুষের কোমর ভাঙার লাইসেন্স পেয়ে গেছে!"
জায়িন ভ্রু কুঁচকে বলল,
"তুমি ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছো। সেটা কি আমার দোষ ছিল?"
"অবশ্যই। আপনি নামার সময় দেখে নামেননি।"
"আমিও তো বলতে পারি, তুমি কেন দেখে উপরে ওঠোনি?"
মাহিমা এদের ঝগড়া দেখছে। মীরা কি সত্যি সত্যিই জায়িন ভাইয়ের সাথে এভাবে ঝগড়া করছে! কী পাষণ্ড! এত হ্যান্ডসাম একটা ছেলের সাথে কেউ ঝগড়া করে? মাহিমা মীরাকে থামিয়ে দিয়ে কানে কানে বলল,
"তুই ভাঙা কোমর বেঁধে জায়িন ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করছিস কেন মীরা? দোষ কিন্তু তোরই।"
মীরা ভস্ম করে দেওয়া চোখে মাহিমাকে দেখলো। তার সমস্ত উল্টাপাল্টা কাজের পার্টনার আজ তার বিরুদ্ধে কথা বলছে! ছি, একটা হ্যান্ডসাম ছেলের জন্য বান্ধবী প্লাস বোনের সম্পর্ককে এভাবে ছোট করে দিবে! মীরা কিড়মিড় করে আওড়াল,
"হারামির বাচ্চা মীরজাফর।"

জায়িন সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়েছিল। কিন্তু মীরার মনে হয় তার সাহার নেওয়ার ইচ্ছে নেই। তাই জায়িনের আর কিছু করার থাকলো না। মীরা কোমর ধরে নড়াচড়া করতে গেলে কোমরের কোন এক হাড্ডি মট করে শব্দ করে উঠল। মাহিমা ওকে ধরতে নিলেও মীরা ঝাড়া মেরে হাত সরিয়ে নিল। চোখ পাকিয়ে বলল,
"একদম দরদ দেখাবি না।"
মীরা মাহিমা ইভাদের বাসায় ঢুকছে। জায়িনও ওদের পেছনে এসেছে। মুবিন এখানেই ছিল। একেতো মীরা মাহিমাকে এখানে দেখে সে যথেষ্ট চমকিত। ওরা কখন এসেছে? মীরা মাহিমার মুখ দেখেই মুবিন বুঝে নিল কোথাও তো গণ্ডগোল বেঁধেছে। সে ভাইকে জিজ্ঞেস করল,
"ওদের কী হয়েছে ভাইয়া?"
"দুইটাই সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়েছে। ব্যথা ট্যথা পেয়েছে হয়তো। দেখ গিয়ে।"
মুবিন চিন্তিত মুখে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। এক ভাই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। আরেক ভাই চিন্তিত হয়। মীরা ভেবেছিল মুবিন ভাই আগে তাকেই জিজ্ঞেস করবে কী হয়েছে। কিন্তু মুবিন মীরাকে উপেক্ষা করে মাহিমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল,

"বেশি ব্যথা পেয়েছ? কীভাবে পড়েছিলে?"
মীরা হাঁ করে মুবিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। এটা কী হলো? ব্যাপারটা এমন হয়ে গেল না যে, বউয়ের থেকে শালির দরদ বেশি! মাহিমা হেসে জবাব দিচ্ছে,
"তেমন কিছু হয়নি মুবিন ভাই। আমাদের যেখানে সেখানে পড়ে যাওয়ার অভ্যেস আছে।"
মীরার এবার কিছুটা সন্দেহ হতে লাগল। কিন্তু মীরার সন্দেহ গুরুতর হওয়ার আগেই মুবিন মীরার জন্যও একইরকম চিন্তিত হয়ে বলল,
"তোমরা কি এখনও বাচ্চা, মীরা? সিঁড়ি থেকে পড়ে যাও কীভাবে? তোমার লাফঝাঁপ করার বয়স কবে যাবে শুনি?"
"আমি কী করেছি মুবিন ভাই? আপনি আমাকে কেন বলছেন? দোষ যে করেছে তাকে বলুন না।"
"কে দোষ করেছে? কার কথা বলছো?"
মীরা মুখ বাঁকিয়ে জায়িনের দিকে দেখাল। জায়িনের এদিকে মনোযোগ আছে বলে মনে হচ্ছে না। সে খালামনির সাথে কথা বলছে। মুবিন মীরার দৃষ্টি অনুসরণ করে জায়িনকে দেখে বলল,
"ভাইয়ার দোষ!"

"অবশ্যই। উনি দেখে নামতে পারলেন না? আমাদের কথাবার্তার শব্দও উনার কানে যায়নি। নিজেই ধাক্কা দিয়ে আবার উল্টে আমাকে দুষেছে জানেন।"
"ভাইয়া মনে হয় সত্যিই তোমাদের দেখেনি।"
"না দেখুক। তবুও তো আমাদের সান্ত্বনা দিয়ে হলেও এই কথাটা স্বীকার করতে পারত।"
"আচ্ছা আমি ভাইয়াকে বলব।"
মীরা মনে মনে ভাবল, মুবিন ভাই কত ভালো। তার হয়ে ভাইয়ের সাথে কথা বলবে! ইভার বাবা ওদের বাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ওরা তা চাইছে না। কারণ আঙ্কেলের সাথে বাড়িতে গেলে সবাই জেনে যাবে ওরা এখানে এসেছে। কিন্তু এতকিছু করেও তো কোন লাভ হলো না। ফেরার সময় দু'জন ঠিক করেছিল বাড়িতে গিয়ে কোমর একটু আধটু ব্যথা করলেও কাউকে বলবে না। কিন্তু ওরা বাড়ি পৌঁছানোর আগেই ওদের সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার খবর বাড়ির প্রতিটা মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। ওরা সদর দরজায় পা রাখতেই বড়মা আর বড় ফুপু ওদের বকাঝকা করতে লাগল, কেন ওরা না বলে আজ ইভাদের বাড়িতে গিয়েছিল। তার সাথেই ছোট ফুপু আর ছোট চাচী ওরা কতটা ব্যথা পেয়েছে তা নিয়ে চিন্তিত। বাড়িতে এখন মিশ্র পরিবেশ। অবশ্য সবসময়ই এমন থাকে। তাই বরাবরের মতো এবারও ইভান ভাই এসে ওদের বাঁচিয়ে নেওয়ার কাজটা করলো। বড় ফুপু তখনো বলছেন,

"মীরা আর তোর মেয়েটা কিন্তু বড্ড পার পেয়ে গেছে। এরা কি এখনও নিজেকে দশ/বারো বছরের বাচ্চা শিশু মনে করে নাকি? বয়সটা তো আঠারোর ঘরে পড়বে। বাংলাদেশের আইনে বিবাহযোগ্যা বয়স। কিন্তু এখনও এদের চালচলন থ্রি ফোরের বাচ্চাদের মতোন। দোষ তোমাদের। তোমাদের আদরে এদের এখনও বাচ্চামি যায়নি। এদেরকে এখন থেকেই শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে। নইলে পরের বাড়ি গিয়ে সংসার করবে কীভাবে?"
উপরে নিজের ঘরে যেতে যেতে ফুপুর কথা শুনে মীরা মুখ ভেংচাল। ফুপুকে সবসময় তার ভালো লাগে। শুধু যখন বিয়ের কথা বলে তখনই আর ভালো লাগে না। মাহিমা খালার স্বর নকল করে ভেঙ্গিয়ে বলল,
"আঠারো বছর বাংলাদেশের আইনে বিবাহযোগ্যা বয়স। তুমি নিজের বয়সটা দেখো না। আমাদের বয়স নিয়ে মাথা ঘামিয়ে তো মাথার চুল পাকিয়ে ফেলে নিজের বয়সটা আরও কয়েক বছর বাড়িয়ে নিয়েছ।"
মীরাও ফুপুকে ভেঙাচ্ছে।

"এখন থেকেই শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে। হইলে পরের বাড়ি গিয়ে সংসার করবে কীভাবে? তোমার ভাগ্য ভালো তোমার একটা ছেলে নেই। নইলে ছেলের বউয়ের জীবন তেজপাতা করে ফেলতে।"
ইভাদের বাড়িতে তেমন কেউ নেই। দুই ছেলে জায়িন, মুবিন হলুদ নিয়ে যাবে না। কিন্তু তাই বলে কি মীরারাও আসবে না! অসম্ভব। বরের বাড়ি থেকে বউয়ের বাড়িতে হলুদ যাবে। বিয়ে বাড়িতে হাজারটা কাজ। সকলের হাত বন্ধ। মীরা শাড়ি নিয়ে ঘুরছে কে পরিয়ে দিবে। তনি আপু আবির ভাইয়ার সাথে রঙঢঙ করে মাত্র গোসলে ঢুকেছে। প্রিয়া আপু তাদের থেকেও বেশি ন্যাকা। সে নিজেও শাড়ি পরতে পারে না। ওদিকে মাহা কাঁদছে। ছোট চাচী কী করছে? মাহিমা ইউটিউবে ঢুকে শাড়ি পরানোর ভিডিও দেখছে। তার কাছে সহজই মনে হচ্ছে। শাড়ি পরানো কঠিন কিছু না। অবশ্য ইউটিউব দেখে মানুষের অপারেশন করাটাও কঠিন কিছু মনে হয় না।
"মীরা আয় আমরা নিজেরাই শাড়ি পরি।"

"যদি ভালো না হয়।"
"চেষ্টা করি অন্তত।"
"আচ্ছা তাহলে তুই আগে পড়।"
ভিডিওতে মহিলাটা যেভাবে যেভাবে দেখাচ্ছে মীরা সেভাবেই মাহিমাকে শাড়ি পরানোর চেষ্টা করছে। তনির গোসল শেষ। সে গুনগুন করতে করতে রুমে এসে দেখে এরা নিজেরাই শাড়ি পরছে।
"শাড়ি পেঁচিয়ে মমি সাজছিস কেন? এভাবে শাড়ি পরে নাকি?"
মীরা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
"তুমি এত দেরি করলে কী করব?"
"আমি তো আর সারাদিন গোসলে থাকতাম না। দুইটা মিনিট অপেক্ষা করতে পারলি না! আচ্ছা এবার আয়, কে আগে পরবি।"
মীরা আগে পরবে। নইলে পরে সাজতে দেরি হয়ে যায়। মাহিমাও আগে পরতে চায়। তাই সে ছুটে আগে তনি আপুর কাছে আসতে নিচ্ছিল। কিন্তু পা বাড়াতে নিলে শাড়িতে আটকে মাহিমা মুখ থুবড়ে নিচে পড়লো। ওকে পড়তে দেখে মীরা তোলার চেষ্টা না করে হাসতে লাগল।
মেয়েরা কোথাও যাওয়ার আগে তাদের যদি আগের দিন থেকেই সাজতে দেওয়া হয়,
তবুও বেরুবার সময় বলবে, সময় কম হয়েছে। আর পাঁচ মিনিট।
এই পাঁচ মিনিট দশ মিনিট গড়িয়ে বিশে পড়লেও শেষ হবে না।
একটু তাড়া দিলে আসছি, এসে পড়েছি বলে আরও আধঘন্টা।
তার পর রাগারাগি শুরু করলে উল্টো গাল ফুলিয়ে যাবে না বলে বসে থাকবে।
তখন ওদের রাগ ভাঙাতে ভাঙাতে আরও কত ঘন্টা যে লাগবে!
আবির এই রিস্ক নিতে চাইল না।
তনির যত সময়ই লাগুক সে আদর্শ বয়ফ্রেন্ডের ভূমিকা পালন করে তনিকে কিছুই বলল না।
কোনরকম তাড়াই দিলো না। নিজে রেডি হয়ে বসে ফোনে গেমস খেলছে।
এদিকে কাজল দিতে গিয়ে প্রিয়ার চোখে পানি এসে কাজল লেপ্টে সাজ নষ্ট হয়েছে।
তার মা ধমকে বলেছিল, কাজল দিতে না পারলো জোর করে দিতে গেলি কেন? ব্যস!
এতেই সে কেঁদেকেটে চেহারার অবস্থা আরও বেহাল করে ফেলেছে।
মীরা, মাহিমা রেডি হয়ে বসে আছে। ছোট হওয়ায় বড়দের মাঝে কথাও বলতে পারছে না।
তনি দ্বিতীয় বার প্রিয়াকে সাজাতে বসেছে। মাহিমা মীরাকে দেখে বলল,
"আজ মুবিন ভাই তোকে দেখে পাগল হয়ে যাবে।
উনার ডাক্তার ভাইও কিছু করতে পারবে না।
প্রেমের পাগলামি ঠিক করতে মুবিন ভাইকে তোর মনের পাগলাগারদে বন্দী হতে হবে।"
"আমার মনে পাগলাগারদ দিয়ে বসে আছি নাকি? প্রশংসা করবি সুন্দর শব্দ দিয়ে কর। পাগলাগারদ বলে আমার মনকে অপমান করছিস কেন?"

চলবে...

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com