Breaking News

মন নিয়ে কাছাকাছি | পর্ব - ৩৫


মাহিমা কলেজে যাওয়ার আগে মীরাকে নিতে এসেছে। গতরাতের ঝড়তুফানের পর আজ সকাল সকাল উঠে কলেজে যাওয়ার কোন মানেই হয় না। এই লেখাপড়া জীবনের অর্ধেক শান্তি, আরাম, ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আজকে আবার দজ্জাল ম্যাম ক্লাস টেস্ট নিবে। না গেলে কালকে সবার সামনে অপমান করবে। মহিমা এখানে এসে দেখে মীরা জ্বর বাঁধিয়ে কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে। মাহিমা মীরার পাশে ধপ করে বসে পড়ে ঠোঁট উলটে বলল,

"ইচ্ছে করে জ্বর বাঁধিয়েছিস না? আমি জানি। ক্লাস টেস্ট দেওয়ার ভয়ে তোর এই জ্বর।"
মীরা কম্বল গলা পর্যন্ত টেনে বসে যাওয়া গলায় চিউচিউ করে বলল,
"তুমি গা গরম হওয়ার আগেই ও বাবা গো, ও মা গো বলে নাটক করো দেখে সবাই কি তোমার মতো নাটক করে মনে হয়? হারামি, হাঁচি দিতে দিতে আমি মরে যাচ্ছি।"
মাহিমা অবহেলাভরে মীরার কপালে হাত রেখে বলল,
"বিলাইয়ের জ্বর। তেমন কিছু না। উঠে রেডি হ। আমি একা কলেজে যেতে পারব না।"
"না গেলে না যাবি। আমার জ্বর এক সপ্তাহ থাকবে। ঔষধ তো দূর, ডাক্তার গুলিয়ে খাওয়ালেও সারবে না।"
ডাক্তারের কথা উঠতে মনে পড়লো, জায়িন ভাইকে নিয়ে ভোর রাতেও একটা স্বপ্ন দেখেছে। এই লোক এক রাতে দুইবার তার স্বপ্নে হানা দিয়েছে। মীরা কারো কাছে শুনেছিল। সঠিক জানে না তাই মাহিমার কাছে জিজ্ঞেস করে শিওর হতে চাইল।

"ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয় এই কথাটা কতটুকু সত্য রে মাহি?"
"কেন? তুই আবার ভোরে কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিস? মুবিন ভাইকে নিয়ে?"
"মুবিন ভাইকে নিয়ে তুই স্বপ্ন দেখ। আমি কেন অন্য বেডির বয়..
রেগে গিয়ে কথাটা বলতে গিয়েও মীরা বলল না। দুনিয়ায় যদি গাধার থেকেও নির্বোধ, বোকা কোন প্রাণী থাকে সেটা এই মাহি। এতদিনেও বুঝতে পারছে না মুবিন ভাই কাকে পছন্দ করে। মীরা ইশারা ইঙ্গিতে কতভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। এই হাদার বাচ্চা মুবিন ভাইকে দুলাভাই বানাতে জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছে।

গতরাতের ঝড়বৃষ্টির পর আজ কলেজে খুব কম সংখ্যক ছেলেমেয়েরাই এসেছে।
যারা এসেছে সেসব ব্রিলিয়ান্টদের মধ্যে মাহিমাও একজন। ছুটির পর একা বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।
ভালো লাগছে না। মীরা সাথে থাকলে বকবক করতে করতে পথ ফুরিয়ে যায়।
মাহিমা কিছুদূর এগিয়ে এসে ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মুবিন মাহিমাকে দেখে এগিয়ে আসছে।
গতরাতে মীরার মেসেজ পড়ে পুরো রাত বেচারা দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি।
টেনশনে অস্থির হয়ে রাতটা কোনরকমে পার করে সকালেই রওনা দিয়েছে।
মীরা কেন তাকে সাহায্য করবে না? সাহায্য ফিরিয়ে নিবে মানে কি?
মীরা কি মাহিমাকে উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে! এই মেয়ের সাথে বিশ্বাস নেই।
মাহিমা মুবিনকে আসতে দেখে বিড়বিড় করে বলল,
" আপনার পাখি তো আজ আসেনি মুবিন ভাই। আপনাকে আজ নিরাশ হয়ে ফিরে যেতে হবে।"
মুবিন মাহিমার কাছাকাছি চলে এলে মাহিমা ঠোঁটে হাসি টানলো। মাহিমাকে হাসতে দেখে মুবিন স্বস্তি পেলো। যাক মীরা উল্টাপাল্টা কিছু বলেনি।
"মুবিন ভাই, কেমন আছেন?"
"ভালো।" মাহিমাকে পাল্টা, 'তুমি কেমন আছো?' জিজ্ঞেস করতে মুবিনের লজ্জা লাগল। তাই বলল, তোমাদের খবর কী?"
"আমার খবর ফার্স্ট ক্লাস। কিন্তু আপনার ছাত্রী জ্বরে পড়েছে।"

"ওহ।"
মাহিমা মুবিনের মুখের দিকে তাকিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারলো না। মীরার জ্বর শুনেও মুবিন ভাইয়ের চেহারায় তেমন কোন উদ্বেগ বা অস্থিরতা প্রকাশ পেলো না। পছন্দের মানুষের গা গরম হলে নিজে প্যারাসিটামল খাওয়া পাবলিক মনে হয় মুবিন ভাই না।
"কাল আপনার কাছে পড়তে গিয়েই বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরেছে।"
"আমি তো কাল বাড়িতে ছিলাম না।"
"আপনি বাড়ি নেই এই কথা মীরা জানতো না?"
"মনে হয় না। ওকে বলার সুযোগ হয়নি।"
মাহিমার সন্দেহ এবার গাঢ় হচ্ছে। মুবিন ব্যাটা কি সত্যি সত্যি মীরাকে পছন্দ করে? পছন্দ না করলে শুধু শুধু টাইম পাস করার ছেলে তো মুবিন ভাই না। মাহিমা কিছু বলছে না। কিন্তু মুবিন কথা চালিয়ে নিতে চাচ্ছে। কী বললে আলাপ দীর্ঘ করা যায় ভাবছে মুবিন।
"তোমাদের পরীক্ষা কবে হবে?"
"শুনেছিলাম দুই মাস পর।"
"কেমন প্রিপ্রারেশন নিচ্ছ?"

মাহিমা তীক্ষ্ণ চোখে মুবিনকে দেখছে। তার এখন মনে হচ্ছে মুবিন ভাই মীরাকে পছন্দ করে না।
করলেও প্রেম ভালোবাসা টাইপ না।
কারণ উনি আসার পর থেকে মীরার সম্পর্কে কোন কথাই জিজ্ঞেস করেনি। মীরার জ্বর
শুনেও ওর জন্য টেনশন না দেখি পরীক্ষা নিয়ে আজাইরা পেঁচাল পারছে।
ওরা কথা বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হাঁটছিল।
মুবিন রাস্তার পাশে ফুটপাত ধরে হাঁটছে। মাহিমা রাস্তায়।
এই রোডে খুব বেশি গাড়ি বাস চলাচল করে না। তবে পেছন থেকে হঠাৎ করে
মোটরবাইক এলে মুবিন মাহিমার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে ওকে রাস্তা থেকে নামিয়ে নিয়েছিল।
বাইকটা একটুর জন্য মাহিমার গা ঘেঁষে যাচ্ছিল। মুবিন ঠিক সময়ে মাহিমাকে টেনে না নিলে হয়তো দুর্ঘটনা ঘটে যেত। মুবিন উত্তেজিত গলায় মাহিমাকে জিজ্ঞেস করছে,
"কোথাও লাগেনি তো? ব্যথা পেয়েছ?"
এতক্ষণে বাইকটা অনেকদূর চলে গেছে। মুবিন ওদিকে তাকিয়ে চাপা ক্রোধে বলল,
"আজকাল ছেলেগুলো বাইক নিয়ে রাস্তায় নামলে ভুলে যায় ওরা পাবলিক প্লেসে বাইল চালাচ্ছে। তোমার কোথাও লেগেছে? তুমি ফুটপাত দিয়ে হাঁটো।"
মাহিমা হতবাক হয়ে মুবিনকে দেখছে। মানুষটার চোখে তার জন্য স্পষ্ট উদ্বেগ,
চিন্তা, কেয়ার দেখতে পারছে। মুবিন ভাই মীরার জন্য তার সাথে এত ভালো আচরণ করছে না।
মাহিমা এবার বুঝতে পারছে। তবে এটা বুঝতে পেরেই সে লজ্জা, অপরাধবোধে কুঁকড়ে গেল।
মুবিন ভাই মীরাকে না তাকে পছন্দ করে।
এটা জানলে মীরা কতটা কষ্ট পাবে ভেবেই মাহিমার বুক কেঁপে উঠল।
মাহিমা জীবনে কোনদিন এমন কোনো কাজ করতে পারবে না যাতে মীরা সামান্যতম কষ্ট পায়।
তাই সে মুবিনকে এড়ানোর জন্য জোরে পা চালালো।
হঠাৎ কী হলো মুবিন বুঝতে পারল না। কথা বলতে বলতে মাহিমা এমন স্বাভাবিক ভাবে ছুটছে কেন?
সে কি ভুল কিছু করে ফেলেছে? মাহিমা পেছন ফিরে মুবিনকে দেখার প্রয়োজন মনে করলো না।
"আপনি কাজটা ঠিক করেননি মুবিন ভাই।
মীরা আপনাকে পছন্দ করে। আপনি কেন আমাকে পছন্দ করতে গেলেন?"
.
মাহিমার হঠাৎ এরকম চলে যাওয়ার মুবিন কিছুই বুঝতে পারছে না। এ নিয়ে বেচারা সারাটা দিন মনমরা হয়ে থেকেছে। ভালোবাসা জিনিসটা তো কঠিন কেন? তার বন্ধুরা একসাথে দুই তিনটা গার্লফ্রেন্ড চালাতে পারতো। সে একটাও বানাতে পারছে না। ভালোবাসা শুধু কি তার জন্যই কঠিন? আগে জানলে ভালোবাসা নামক এই ফাঁদে জীবনেও পা দিতো না। কিন্তু এখন তো দিয়ে ফেলেছে। ফিরে আসার কি কোন পথ আছে? হয়তো আছে। কিন্তু মুবিন ফিরে আসতে চায় না। এই অনুভূতিটা ভীষণ সুন্দর।

বিকেলে মুবিন মায়ের সাথে বসে টিভি দেখছে। টিভি দেখছেও বলা যায় না।
মা সিরিয়াল দেখছে। সে শুধু শুধু বসে আছে।
মাঝে মাঝে কথা বলার চেষ্টা করলেও মা'র মনোযোগ এখন ইন্ডিয়ান সিরিয়াল থেকে সরছে না।
জায়িন ঘুম থেকে উঠে এলোমেলো চুলে মা ভাইয়ের কাছে এসে বসলো।
মুবিন ভাইকে দেখলো। ট্রাউজারের এক পা উপরে উঠে আছে।
চোখে মুখে এখনও ঘুম জড়ানো। ফোলা ফোলা চেহারায় ভাইয়াকে সুন্দর লাগছে।
মুবিন ভাবল, তার ভাইটাই ভালো। যখন খুশি তখন ঘুমানো এক বিরল প্রতিভা নিয়ে জন্মেছে।
বাড়িতে এলে সারাদিনই ঘুমায়। মুবিন বুঝে না,
দিনের বেলা এত ঘুমানোর পর ভাইয়া রাতের বেলা কী করে?
আর ঘুম থেকে উঠেও ভাইয়ার মেজাজ এত ভালো থাকে কীভাবে?
মুবিন দিনের বেলা ঘুমালে তার সাথে যে সমস্যা গুলো হয়।
তার মধ্যে এক নম্বর, ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারে না দিন না রাত।
বিকেলে উঠলেও মনে হয় রাত হয়ে গেছে।
বা একটা রাত পুরো ঘুমিয়ে সকালে উঠেছে।
দুই নম্বর সমস্যা, মেজাজ খিটমিটে হয়ে থাকে৷ কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
কেউ কথা বললেও কলিজা কাঁপানো ধমক দিতে ইচ্ছে করে।
তাই মুবিন দিনের বেলা ঘুমানোই বাদ দিয়েছে।
"কী দেখছিস?"
জায়িনের কথায় মুবিন লজ্জা পেলো।
সে এতক্ষণ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল বুঝতে পেরে দু'পাশে মাথা নাড়ল।
জায়িন একনজর মা'র দিকে তাকিয়ে নিজেই উঠে কিচেনের দিকে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরই দুইটা মগ হাতে নিয়ে ফিরল।
ফিরে এসে নিজের জায়গায় বসে বাঁ হাতে ধরা মগটা মুবিনের দিকে এগিয়ে দিল।
মুবিন মগটা নিলে জায়িন আরাম করে নিজের মগে ঠোঁট ছোঁয়াল।

"মা কফি খাবে?"
"না। তুই খাবি? করে দিব?"
জায়িন হাসলো। বলল,
"না থাক। তোমার ডিস্টার্ব হবে।"
মুবিন ভাইয়ের দিকে ফিরে গলা নিচু করে বলল,
"দেখলে ভাইয়া, মা পুরোপুরি সিরিয়ালে আসক্ত হয়ে গেছে।"
"বাবা ফিরলেই ঠিক হয়ে যাবে।"
"বাবা কবে ফিরবে জানো?"
"বলেছিল তো এই সপ্তাহে আসবে।"
"হিসেব করলে দেখা যাবে, বারো মাস থেকে বাবা কিন্তু আমাদের সাথে তিন মাসও ভালো ভাবে থাকে না।"
"তুই চাস বাবা বারো মাসই বাড়িতে থাকুক?"
প্রশ্নটা করে জায়িন কফিতে চুমুক দিয়েছে। মুবিন এই প্রশ্নটার উত্তর দিলে মিথ্যা বলতে হবে।
সত্যটা ভাইয়ার কাছে বলা যাবে না। বাড়িতে সে আর মা একা একা থাকতে থাকতে অভ্যেস হয়ে গেছে।
এখন বাবা বাড়ি এলে তার স্বাধীনতা বিগ্ন হয়। মনে মনে চায়, বাবা কবে যাবে।
ভাইয়া বাড়ি এলে ভালো লাগে। কারণ ভাইয়া তো তাকে বাবার মতো শাসন করে না।
জায়িন ভাইকে চুপ থাকতে দেখে মুচকি হাসলো।
মুবিন রুমে গিয়ে বাইকের চাবি নিয়ে এলো। বেরুবার আগে মা'কে বলল,

"আম্মু আমি একটু বেরুচ্ছি।"
সুমনা ছেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
"এখন কোথায় যাচ্ছিস? মীরা পড়তে আসবে না?"
"আজ মনে হয় আসবে না। মীরার জ্বর।"
"সে কি! জ্বর কীভাবে বাঁধাল? এই সিজনের জ্বর তো ভালো না। ইভাকে কল করে জান তো অনেক জ্বর নাকি।"
মীরার জ্বর এসেছে শুনে জায়িন পিঠ সোজা করে বলল।
নিশ্চয় বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় পড়ায় এই জ্বর এসেছে।
মীরা এসময় পড়তে আসে ভেবেই জায়িন ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল।
যাতে মীরার সাথে দেখা হয়।
গতরাতের পর মীরাকে দেখার যে তীব্র ইচ্ছাটা দমন করে রেখেছিল তা এখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
মেয়েটা তাকে এত জ্বালায় কেন?

চলবে...

No comments

info.kroyhouse24@gmail.com