রুপের তরী । পর্ব - ০৪
কারও নরম ঠোঁটের আলতো স্পর্শ কপালে সহ গালে ও হাতে অনুভূত হতে লাগলে ঘুম থেকে জেগে ওঠে রূপ।ঘুম ভাঙলে দেখতে পায় তরী ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে।
তরীর মুখটা রূপের মুখের সাথে একদম লেগে আছে। রূপের কিছুটা হাসি পায় তরীকে এভাবে দেখে। মেয়েটা যে আসলেই পাগলী।তারপর ভাবে, হয়ত বোনকেও এমনভাবে জড়িয়ে ধরে ঘুমোয়।
তরীকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে সুন্দর করে নিজের জায়গায় শুইয়ে দেয়। চুলগুলো না থাকায় একদমই বাচ্চাদের মত লাগছে তরীকে দেখতে৷ রূপ চাইছে তরীর কপালে ভালেবাসার পরশ একে দিতে। কিন্তু সে এমন কিছুই করলো না।
আবারও নিজের জায়গায় গিয়ে তরীর দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লো।
বিছানার দু পাশেই বিশাল বিশাল কাঁচের জানালা।
কাচের জানালা ভেদ করে চাদের রূপালি আলো তরীর মূখে এসে পড়ছে। এতে ওর মুখটা দেখতে আরও আকর্ষনীয় হয়ে উঠছে। রূপ সেদিকে তাকিয়ে ভাবনার সাগরে ডুব দিল।
রূপের বাবা মা ভালোবেসেই খুব কম বয়সে বিয়ে করেছিল।তখন দুজনেই মেডিকেল স্টুডেন্ট।
আসলে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করার কারনটাও বড় ছিল। রূপের মা প্রেনেন্ট ছিলেন।
রিশাদ চৌধুরী (রূপের বাবা) ওর মাকে ঠকাতে চেয়েছিলেন না বলে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নেন।
কয়েকমাস যাওয়ার পর রূপ জন্ম নেয়।
তবে রূপের মা নিজের ক্যারিয়ার ঠিক করার লক্ষ্য রূপের বাবার সাথে ঝামেলা করেন।
এরপর রিশাদ চৌধুরীর অনিচ্ছা সত্তেও দুজনের আলাদা হয়ে যেতে হয়।
রূপের মা চাননি রূপকে নিতে। তাই রূপ তার বাবার কাছেই বড় হতে থাকে।
রিশাদ চৌধুরী নিজের ছেলেকে ও ক্যারিয়ার দূটোই সমানভাবে পরিচালনা করতে থাকে।
এক পর্যায়ে এসে উনি সুখের মুখ দেখেন।
আস্তে আস্তে রিশাদ চৌধুরী একজন বড় ডক্টর হয়ে সাফল্য অর্জন করেন।
রূপের মা আফসোস করলেও আর কোন ভাবেই রিশাদ চৌধুরীকে মানাতে পারেন না।
নিজের ছেলে ও কাজ নিয়ে সবসময় বিজি থাকতেন তিনি।
রুপ ছোটবেলা থেকেই বাবা মায়ের মত প্রচুর মেধাবী।তাইতো এখন সে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নি করতে পারছে।
মায়ের শূন্যতা রিশাদ চৌধুরী কখনোই উপলব্ধি করতে দেন নি রূপকে। রূপও কখনো মায়ের কাছে যেতে চায়নি। ওর কাছে ওর বাবাই সব।
...
সেদিন পানিতে তরীকে ডুবতে দেখে রিশাদ চৌধুরীই উদ্ধার করেন। মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে একটা মায়া ও স্নেহের অনুভূতি জাগে। তাই চার পাঁচ দিন ধরে ওর সব খবরাখবর নিয়ে সোজা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। উনি ইচ্ছে করেই টাকাগুলো এনেছিলেন যাতে, তরীকে নিজের বাড়ির বউ বানানোয় কোন শংশয় না থাকে। এবং এ শংশয় কেটে গেল যখন রেজিস্ট্রি পেপারে তরী সাইন করলো।
(একটা জিনিস ক্লিয়ার করি,বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারে কনের স্বাক্ষর তার বাবা করলে যেমন বিয়ে হবে,তেমনি ছেলের বাবা ছেলের হয়ে স্বাক্ষর করলেও বিয়ে হবে,এটা অনেকের কাছেই গোলমাল লেগেছে।তাই বলে দিলাম)
ভাবনার ঘোরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল রূপ তার ঠিক নেই। মুখে পানির ছিটা পড়ায় চোখ টিপে টিপে ঘুম ভাঙ্গল ওর। ব্যাপারটা কিছুটা বিরক্তির হলেও সেটাই আবার তরীকে দেখে ভালেলাগায় পরিনত হলো।
হাসি মুখে তরীর দিকে চেয়ে মুচকি হেসে দিয়ে বলল,
--সকাল সকাল পানি ছিটিয়ে ঘুম ভাঙ্গাচ্ছেন যে?আপনার হাত দিয়ে কি ডাকতে পারলেন না?
রূপের হাসি দেখে তরীর কেমন অবাক লাগে। কি অদ্ভুত মানুষটা। সবসময় শুধু হাসে। কাল রাত থেকে একটা কথাও কি না হেসে বলেছে?
রূপ হাতের তুড়ি বাজিয়ে বলল,
--কি হলো?কোন রাজ্য ভাসলেন রূপের তরী?
--এ্য? না না আসলে ভাবলাম আপনাকে ছুয়ে কিভাবে ডাকবো মানে?(মাথা নিচু করে)
রূপ এবার জোড়ে জোড়ে হেসেই চলেছে। তরী ভাবছে পাগল হয়ে গেল নাকি লোকটা?।
রূপ হাসতে হাসতে পেট ধরে শ্বাস নিতে থাকে। আর হাপানো গলায় বলে,
--আপনি আমায় হাসিয়েই মারবেন দেখছি। ওহ মোর খোদা,তুমি কি শুনছো?রুপের তরী কি বলছে?আমায় নাকি হাত দিয়ে ছুয়ে ডেকে দিতে লজ্জা। হা হা হা(হাসতে থাকে)
--কেন?আমি কি করলাম?
--কাল রাতে আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে ধরে ঘুমিয়েছেন আর এখন বলছেন কি করলাম?(তরীর দিকে বাকা চোখে তাকিয়ে)
তরী কাল রাতে এমন কিছুরই ভয়ে ছিল। বাড়িতে থাকাকালীন মিলিকে প্রায়ই এমন জরিয়ে ধরে ঘুমোতো সে। কিন্তু কাল রাতে?ছি ছি, এ কি কাজ করেছে সে?ভাবতেই কেমন লাগছে ওর ।
--লজ্জা পাবেন না। কবুল না বললেও লিগ্যালি হাসবেন্ড ওয়াইফ আমরা। সো..
তরী আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। আর যাই হোক কাল রাতে কাজটা একদমই ঠিক হয়নি। তরী ভেবেছিল রূপ ওকে কিছু করবে তবে উল্টে ও নিজেই এমন কান্ড করে বসে আছে।
বেসিনের আয়নায় মুখটা দেখছে সে। আচ্ছা এই রুপের কারনে কি এত কিছু?সবাই তাহলে রুপের পাগল। মনের ভেতর টা কেউই দেখল না।
ওয়াশরুমের দরজায় নক করার আওয়াজ হলে তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দেয় তরী।
অমনি রূপ হাসিমুখে বলে,
--আপনার হয়ে গেলে নিচে চলে যান। ব্রেকফাস্ট এর জন্য বাবাও বসে আছেন।আনি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
তরী ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলে রূপ ভেতরে ঢোকে। একটা জিনিস তরীর খুব ভালো লাগছে। রূপের চেহারায় সবসময় হাসিটা বজায় থাকে।
যেন হাসিটা ওর মুখের জন্যই তৈরী।
মাথাটা বেবি পিংক হিজাবে আটকে নিচে চলে যায় তরী। বিশাল আকারের ডাইনিং টেবিলের এক প্রান্তে বসে আছেন রিশাদ চৌধুরী।
তরীকে আসতে দেখে বললেন,
--এখানে বসো তরী। (সামনের চেয়ারটি দেখিয়ে)
তরীও বাধ্য মেয়ের মত বসে পরে।
সাথে সাথে একজন সার্ভেন্ট এসে তরীর সামনে থাকা প্লেটে ব্রেকফাস্ট দিয়ে যায়।
রিশাদ চৌধুরী আবারও বলেন,
--তোমার সাথে আমার পরিচয়টা হয়নি। কিন্তু আমার মনে হয় রূপ জানিয়েছে আমি কে। আমি তোমার শশুড়।তবে তোমার যা ভালোলাগে তাই বলেই আমায় ডাকতে পারো।যেমন ধরো,বাবা,আব্বু,আব্বা(বলেই হালকা হেসে দেন)।
তরীও ওনার কথায় খানিক হেসে ওঠে।
--আচ্ছা তরী মা, তেমায় একটা কথা বলার ছিল।।
তরী ওনার দিকে তাকিয়ে বলল,
--জ্বি বাবা বলুন?
--কাল থেকে তুমি কলেজ যাবে। আমি তোমার যাবতীয় পড়াশুনার ব্যাপারে এখানকার একটা কলেজ ঠিক করেছি।কাল থেকে তুমি সেখানে যাবে।
কলেজ।কথাটি শুনে মন আনন্দে নেচে ওঠে তরীর। এখন তো নিজের শশুরকে মাথায় তুলে নাচতে ইচ্ছে করছ ওর। আর যাই হোক পড়াশুনা ও করতে পারবে৷ এটাই যথেষ্ট।
--কিন্তু বাবা, আমায় কে নিয়ে যাবে। মানে আমি তো এখানকার কিছুই চিনিনা।
--তরী মা, এত বোকা হলে কি করে হবে বল তো?তোকে তো রূপ দিয়ে আসবে৷ তবে আসার সময় আমাদের যে কোন একটা ড্রাইভার তোমায় গিয়ে আনবে। কেমন?
--ওহহহ,তাহলে ঠিক আছে।
রূপ সিড়ি বেয়ে নামতে নামতে তরীর দিকে তাকায়। তরীর মাঝে এতটাই বিভোর হয়ে যায় যে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়।হালকা মাজায় ব্যাথা পায় সে৷
তরী ব্যাপারটা দেখে প্রথমে হেসে ওঠে৷ এবং বলে,রাস্তা দেখে চলা উচিত ।।।।
..
রুমে যাওয়ার পর একা থাকায় নাচানাচি শুরু করে দেয় তরী। আবার নিজের প্রিয় বন্ধুদেরকে ফিরে পাবে সে। বাহ কি মজা। বই ছাড়া তরী আর তরী ছাড়া বই কেমন যেন ফিকে ফিকে লাগে। যতই হোক সম্পর্কটা ছোট থেকেই গভীর অনেক৷
রূপ ব্রেকফাস্ট শেষ করে রুমে এসে তরীর এমন কান্ডে হাসতে শুরু করে দেয়।
তরী যখন বুঝতে পারলো রূপ দরজার পাশে দাড়িয়ে আছে, ওর কান দিয়ে ধোয়া বেরুতে শুরু করলো।
ইশশশ রে আবারও ওনার সামনে কি করলাম আমি।
তবে উনি না খেয়ে রুমে এলেন যে?(গালে হাত দিয়ে ভাবতে থাকে)
--আচ্ছা আপনি না খেয়ে চলে এলেন যে?
--না খেয়ে কোথায় এলাম হুম?খেয়েই তো এলাম।।
--এত তাড়াতাড়ি?
--আমি একজন ডক্টর। এবং একজন ডক্টরের অনেক টাইম মেইনটেইন করে চলতে হয়।
খাওয়ার বিষয় থেকে শুরু করে আমি সকল কাজ তাড়াতাড়ি করে করতে পছন্দ করি।
--ওওহ।
বিছানার ওপর এতক্ষণ বসে ছিল তরী।ঘুম থেকে উঠার পর পরই কিছুটা শরীর খারাপ লাগছিল ওর।
এখন ব্যাপারটা আরও বেশি খারাপ লাগছে। মাথা ব্যাথা করছে খুব।
বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে শেলফের ওপর থাকা ঔষধের বক্স থেকে একটা নাপা এক্সট্রা খেয়ে নেয়।
রূপ তরীর একটা জিনিস খেয়াল করেছে। তবে বলতে পারছেনা।
মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে সে।
ঔষধ খাওয়া হয়ে গেলে বিছানার একপাশে গিয়ে শুয়ে হেলান দিয়ে বসে পড়ে।
এরপর কিছু একটা দেখে চোখ বন্ধ করে চিতকার দেয়...
---নাআআআআ..
চলবে.....
No comments
info.kroyhouse24@gmail.com